বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহর গড়ে ওঠার গল্প
ঢাকা শহরের গড়ে ওঠার গল্পটি দীর্ঘ এবং সমৃদ্ধ ইতিহাসের মধ্যে নিহিত। এই শহরটি বাংলাদেশের রাজধানী এবং সবচেয়ে বড় শহর হিসেবে পরিচিত। এর ইতিহাস হাজার বছরের পুরানো এবং বিভিন্ন সময়কালে এটি বিভিন্ন শাসক, সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের কেন্দ্রস্থল হিসেবে বিকশিত হয়েছে।
প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইতিহাস
ঢাকা শহরের ইতিহাস প্রায় ১,০০০ বছর পুরানো। এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১০০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি। তবে, এর আগে থেকেই এখানে বসতি ছিল। ৭ম শতাব্দীর শুরুতে এখানে হিন্দু এবং বৌদ্ধ সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়।
মুঘল আমল
ঢাকা শহরের আধুনিক ইতিহাসের সূচনা মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনামলে। ১৬০৮ সালে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে ইসলাম খানের নেতৃত্বে ঢাকা মুঘল বাংলার রাজধানী হয়। তিনি শহরটির নামকরণ করেন "জাহাঙ্গীরনগর"। মুঘল শাসনের সময়ে ঢাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এখানে মসলিন কাপড়ের জন্য বিখ্যাত ছিল, যা ইউরোপসহ বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি হতো।
ব্রিটিশ শাসন
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ব্রিটিশরা নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর বাংলার ক্ষমতা দখল করে। ব্রিটিশ শাসনের সময় ঢাকা কিছুটা অবহেলিত হয় এবং কলকাতা প্রধান বন্দর নগরী হিসেবে বিকশিত হয়। তবে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ঢাকা পুনরায় গুরুত্ব পেতে শুরু করে এবং ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় এটি পূর্ব বাংলার রাজধানী ঘোষণা করা হয়।
পাকিস্তান আমল
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর ঢাকা পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) রাজধানী হয়। এই সময়ে ঢাকা শহর দ্রুত বিকাশ লাভ করে এবং একটি আধুনিক নগরীতে পরিণত হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি ভবন এবং শিল্প কারখানা গড়ে ওঠে।
স্বাধীন বাংলাদেশ
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর ঢাকা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হয়। স্বাধীনতার পর থেকে ঢাকা শহর দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আধুনিক ঢাকা একটি মেট্রোপলিটন শহরে পরিণত হয়েছে যেখানে প্রায় দুই কোটি মানুষ বসবাস করে।
স্থাপত্য ও সংস্কৃতি
ঢাকা শহরে অনেক ঐতিহাসিক এবং আধুনিক স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে। লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, হাতিরঝিল, জাতীয় সংসদ ভবন (লুই কান ডিজাইন করা) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ঢাকায় প্রচুর মসজিদ, মন্দির এবং অন্যান্য ধর্মীয় স্থান রয়েছে, যা শহরটির বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে।
সমসাময়িক ঢাকা
আজকের ঢাকা একটি জনবহুল ও ব্যস্ত নগরী। এটি দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা এবং প্রশাসনের কেন্দ্র। ঢাকা শহরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, কর্পোরেট অফিস, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে, দ্রুত নগরায়ণের ফলে ঢাকার বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ যেমন ট্রাফিক জ্যাম, বায়ুদূষণ এবং জনসংখ্যার চাপ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
ঢাকার এই দীর্ঘ ও বৈচিত্র্যময় ইতিহাস শহরটিকে একটি অনন্য পরিচয় প্রদান করেছে এবং এটি বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে।
কোন মন্তব্য নেই