Header Ads

Header ADS

বিগত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ওঠা সমালোচনাগুলো

 

শেখ হাসিনার শাসনামলকে নিয়ে আলোচনা করলে একদিকে যেমন তার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের কথা বলতে হয়, অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে ওঠা সমালোচনাগুলোও তুলে ধরতে হয়। তার শাসনামলকে “দুঃশাসন” হিসেবে চিহ্নিত করার পেছনে যে কারণগুলো উঠে এসেছে, সেগুলোকে আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:

১. বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড

বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) এবং পুলিশের হাতে "ক্রসফায়ার" বা "বন্দুকযুদ্ধে নিহত" হওয়ার ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো কঠোর সমালোচনা করেছে। এই হত্যাকাণ্ডগুলো সরকার সমর্থিত দমননীতির অংশ হিসেবে দেখা হয়েছে, যেখানে বিচারব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

২. গুম ও নিখোঁজের ঘটনা

শেখ হাসিনার শাসনামলে গুম এবং নিখোঁজের ঘটনাগুলো বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী, সাংবাদিক, এবং মানবাধিকার কর্মীদের গুমের অভিযোগ উঠেছে। অনেকের পরিবার অভিযোগ করেছে যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের প্রিয়জনকে তুলে নিয়ে গেছে, কিন্তু তারা আর ফিরে আসেননি। এসব ঘটনায় দায়মুক্তির সংস্কৃতি প্রচলিত হয়েছে বলে সমালোচকরা মনে করেন।

৩. মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ ও সাংবাদিক নিপীড়ন

শেখ হাসিনার শাসনামলে গণমাধ্যমের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে সমালোচনা রয়েছে। এই আইনের আওতায় অনলাইনে সরকারের সমালোচনা করলে সাংবাদিকরা গ্রেফতার হয়েছেন। কিছু সংবাদমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বা সেগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে। এর ফলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং তথ্যের স্বাধীন প্রবাহ ব্যাহত হয়েছে।

৪. বিরোধী দলকে দমনের কৌশল

বিরোধী দল বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে সরকারি নিপীড়নের অভিযোগ রয়েছে। বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলায় জড়ানো, গ্রেফতার, এবং নিপীড়নের ঘটনা রাজনৈতিক দমননীতির অংশ হিসেবে দেখা হয়েছে। বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা দুর্নীতির মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করা হয়। এভাবে বিরোধী দলগুলোর কার্যক্রমকে সংকুচিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

৫. নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অনিয়ম

শেখ হাসিনার শাসনামলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনগুলোতে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলো বর্জন করেছিল, যার ফলে আওয়ামী লীগ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনেক আসনে জয়ী হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোট কারচুপি, প্রার্থীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, এবং সহিংসতার অভিযোগ ব্যাপক ছিল। এসব ঘটনায় নির্বাচনগুলোর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

৬. দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার

শেখ হাসিনার শাসনামলে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে দুর্নীতি এবং অনিয়মের অভিযোগ ওঠেছে। বিশেষ করে পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, এবং অন্যান্য বড় প্রকল্পে ব্যয়ের অসঙ্গতি এবং টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে সমালোচকরা মনে করেন।

৭. স্বাধীন বিচারব্যবস্থার সংকট

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে শেখ হাসিনার শাসনামলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার পদত্যাগ এবং বিদেশে চলে যাওয়া বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের একটি নজির হিসেবে ধরা হয়। এর ফলে বিচার বিভাগের ওপর সরকারের প্রভাব বেড়েছে বলে সমালোচনা উঠেছে। রাজনৈতিক মামলাগুলোতে সরকার-সমর্থিত রায় পাওয়ার অভিযোগও রয়েছে।

৮. জনমত দমনের জন্য আইনি ব্যবস্থা

শেখ হাসিনার শাসনামলে আইন ব্যবস্থার অপব্যবহার করে জনমত দমনের অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, তথ্য প্রযুক্তি আইন, এবং অন্যান্য আইনগুলোকে ব্যবহার করে সরকারের সমালোচকদের, মানবাধিকার কর্মীদের, এবং বিরোধী দলীয় নেতাদের ওপর মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই আইনি ব্যবস্থাগুলোকে একটি নিপীড়নমূলক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বলে সমালোচনা রয়েছে।

৯. শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে দলীয়করণ

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং চাকরির ক্ষেত্রে দলীয়করণ এবং রাজনৈতিক সংযোগের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের প্রভাব, শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দের প্রভাব, এবং সরকারি চাকরিতে রাজনৈতিক বিবেচনার অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বেড়েছে।

১০. ব্যক্তিগত পূজা ও ক্ষমতা কেন্দ্রীভূতকরণ

শেখ হাসিনার শাসনামলে আওয়ামী লীগের ভেতরে ব্যক্তিগত পূজা এবং ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দলীয় সিদ্ধান্তগুলোতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অগ্রাধিকার এবং শেখ হাসিনার প্রতি অতিরিক্ত আনুগত্য প্রকাশিত হয়েছে। দলীয় ভেতরে গণতন্ত্র এবং ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ কমে গেছে বলে সমালোচনা রয়েছে।

১১. অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান

শেখ হাসিনার শাসনামলে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানগুলো প্রশংসিত হলেও, সেগুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে অভিযুক্তদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, এবং নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।

শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি এবং অবকাঠামো উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে। তবে, এই সাফল্যের বিপরীতে মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি, রাজনৈতিক দমননীতি, এবং গণতন্ত্রের সংকটের মতো বিষয়গুলো নিয়ে যে সমালোচনা উঠেছে, তা তার শাসনামলকে একটি বিতর্কিত আলোচনার কেন্দ্রে এনে দিয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.